ইভটিজিং কি | ইভটিজিং কাকে বলে | ইভটিজিং বলতে কি বুঝায়
ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি আধুনিক সমাজের একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা নারীর স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও সম্মানকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। শহর কিংবা গ্রাম বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে ইভটিজিং এক নিঃশব্দ আতঙ্ক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রীদের প্রতিনিয়তই এই অসভ্য আচরণের শিকার হতে হচ্ছে, যা তাদের মানসিক বিকাশ, শিক্ষাজীবন ও ভবিষ্যৎকে বাধাগ্রস্ত করে। এক শ্রেণির যুবক মেয়েদের উদ্দেশ্যে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অশ্লীল ইঙ্গিত, পথরোধ বা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ করে থাকে, যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘনই নয়, বরং একটি জাতির মূল্যবোধ ও মানবিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইভটিজিং বন্ধ করতে হলে শুধু আইন প্রয়োগ করলেই চলবে না; প্রয়োজন সচেতনতা, পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক উদ্যোগ এবং মূল্যবোধভিত্তিক জীবনচর্চার। এই প্রবন্ধে আমরা ইভটিজিং-এর প্রকৃতি, কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব।
ইভটিজিং কি
ইভটিজিং একটি ঘৃণিত সামাজিক অপরাধ, যা নারীর প্রতি মানসিক, মৌখিক কিংবা শারীরিকভাবে উত্ত্যক্ত করার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। সাধারণত, এটি ঘটে জনসমাগমস্থলে—যেমন রাস্তাঘাট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা অফিসের আশেপাশে। ইভটিজিং-এর মধ্যে পড়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অশ্লীল গানে বাজানো, হাসাহাসি, চোখে চোখ রাখা, ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেওয়া, পিছু নেওয়া বা ভিডিও ধারণের মতো কর্মকাণ্ড। এটি নারী বা কিশোরীদের মানসিকভাবে আঘাত করে এবং তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, পড়াশোনা ও জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করে।
ইভটিজিং শুধু ব্যক্তি নারী নয়, বরং পুরো সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। অনেক সময় এই উত্যক্ততা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ভুক্তভোগী মেয়েরা মানসিক বিষণ্নতায় ভোগে, শিক্ষা বন্ধ করে দেয় বা আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। এ কারণে ইভটিজিংকে শুধু একটি ব্যক্তিগত অপরাধ না ভেবে, সামাজিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা জরুরি, যার প্রতিকার প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে।
ইভটিজিং বলতে কি বুঝায়
ইভটিজিং বলতে বোঝায় নারী বা কিশোরীদের উদ্দেশ্য করে প্রকাশ্যে বা গোপনে কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ও বিরক্তিকর আচরণ করা, যার মাধ্যমে তাদেরকে মানসিকভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত বা ভয়ভীতির মধ্যে ফেলা হয়। এ ধরনের আচরণে রয়েছে অশ্লীল মন্তব্য, কু-ইঙ্গিত, অনুসরণ, শরীরের প্রতি অশোভন দৃষ্টি, স্পর্শ করার চেষ্টা বা পথরোধ করা। মূলত, ইভটিজিং এমন এক ধরনের যৌন হয়রানি, যা নারীর ব্যক্তিত্ব, নিরাপত্তা ও সম্মানকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন এবং নারীর স্বাধীন চলাফেরার একটি বড় বাধা।
ইভটিজিং এর কারণ কি
বর্তমান সমাজে ইভটিজিং একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু নারীদের জন্যই নয়, পুরো সমাজের জন্যই এক চরম হুমকি। ইভটিজিংয়ের ফলে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্যার মূলে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন এর মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং প্রতিকারের পথ খুঁজে বের করা।
প্রথমত, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইভটিজিংয়ের একটি বড় কারণ। অনেক তরুণের মধ্যে মূল্যবোধ, শালীনতা ও সম্মানের শিক্ষা সঠিকভাবে গড়ে ওঠে না। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে, তাহলে তারা ভুল ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে এবং নারীদের প্রতি অবমাননাকর মনোভাব পোষণ করে।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক অবক্ষয় ও অপসংস্কৃতির প্রভাব আজকের তরুণ প্রজন্মের আচরণে গভীর ছাপ ফেলছে। মিডিয়া, সিনেমা, নাটক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা অনেক সময় তরুণদের ভুল বার্তা দেয় এবং নারীদেরকে বস্তু হিসেবে বিবেচনা করতে শেখায়।
তৃতীয়ত, আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচারহীনতা অপরাধীদের সাহস জোগায়। অনেক সময় ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েরা সামাজিক লজ্জা ও অপমানের ভয়ে চুপ থাকে এবং অপরাধীরা আইনের আওতায় আসেও না। এতে করে অপরাধ আরও বাড়তে থাকে।
চতুর্থত, বেকারত্ব ও সময়ের অপব্যবহার ইভটিজিংয়ের আরেকটি মূল কারণ। কাজ না থাকলে এবং উপযুক্ত দিকনির্দেশনা না পেলে তরুণরা সময় নষ্ট করে, যা অনেক সময় অপরাধমূলক কাজে রূপ নেয়।
পঞ্চমত, পারিবারিক অনুশাসনের অভাব অনেক তরুণদের সঠিকভাবে বড় করে তোলা হয় না বা অভিভাবকরা সন্তানদের চলাফেরা ও বন্ধু নির্বাচনের দিকে নজর দেন না। এতে তারা খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মিশে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
সবশেষে, বন্ধুবান্ধবের নেতিবাচক প্রভাব অনেক তরুণকে ইভটিজিংয়ে উৎসাহিত করে। দলবদ্ধভাবে ঠাট্টা বা বিরূপ মন্তব্য করে তারা এটিকে একধরনের ‘মজা’ বলে মনে করে, যা আসলে একটি ঘৃণ্য অপরাধ।
এই কারণে দেখা যায়, ইভটিজিং কোনো একক ঘটনার ফল নয়; বরং এটি সমাজ, পরিবার, শিক্ষা ও আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার সম্মিলিত দুর্বলতার প্রতিফলন। একে প্রতিরোধ করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নৈতিক শিক্ষার বিস্তার। নারীকে সম্মান করা ও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করা একটি সভ্য সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।
ইভটিজিং প্রতিরোধে আইন
ইভটিজিং একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ, যা নারী ও কিশোরীদের সম্মান, নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
১. দণ্ডবিধি ১৮৬০ (Penal Code, 1860)
এই আইনের ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ কোনো নারীকে অপমান করার উদ্দেশ্যে অশোভন ইঙ্গিত, কথা বা আচরণ করে, তবে তার জন্য সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
এই আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো নারীকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করে বা অশালীন প্রস্তাব দেয় কিংবা উত্ত্যক্ত করে, তবে তার জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
৩. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (আইসিটি আইন)
এই আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ ইন্টারনেট বা ডিজিটাল মাধ্যমে অশ্লীল, মানহানিকর বা উত্ত্যক্তকর কোনো তথ্য প্রকাশ বা প্রেরণ করে, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮
আইসিটি আইনের জায়গায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইনে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে নারীদের হয়রানির ক্ষেত্রে দোষীদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দেশনা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বোর্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ইভটিজিং প্রতিরোধ কমিটি’ গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে। এর মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
৬. হটলাইন ও অভিযোগ কেন্দ্র
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ইভটিজিংয়ের শিকার নারীরা এখন ১০৯ (নারী ও শিশু সহায়তা হেলpline) নম্বরে ফোন করে সরাসরি অভিযোগ করতে পারেন।
ইভটিজিং প্রতিরোধে এসব আইন অত্যন্ত কার্যকর, তবে আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন সচেতনতা, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক সহযোগিতা। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি যদি আমরা সবাই একযোগে সচেতন হই এবং অপরাধের প্রতিবাদ করি, তবেই একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ইভটিজিং প্রতিরোধে করণীয়
ইভটিজিং আজকের সমাজে একটি ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে পরিণত হয়েছে। নারী ও কিশোরীদের প্রতি উত্ত্যক্ততা, অশালীন মন্তব্য বা আচরণ শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজের জন্য অপমানজনক ও ক্ষতিকর। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় অনুসরণ করতে হবে।
১. পারিবারিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চা
সন্তানের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি সম্মান, শালীনতা ও শিষ্টাচার শেখাতে হবে। পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের চলাফেরা, ব্যবহার ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি নজর রাখা।
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভটিজিং বিরোধী সচেতনতা কর্মসূচি, সেমিনার, আলোচনা সভা ও দেয়ালিকা কার্যক্রম চালু রাখা উচিত। শিক্ষার্থীদের আইনি জ্ঞান প্রদান করা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. কঠোর আইন প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার
ইভটিজিংয়ের ঘটনায় দ্রুত অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে ভবিষ্যতে অন্যরা সতর্ক হবে।
৪. কমিউনিটি পর্যায়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা
স্থানীয়ভাবে বাসা, মহল্লা ও বাজার এলাকায় ইভটিজিং বিরোধী কমিটি গঠন করে নজরদারি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে পোস্টার, লিফলেট ও ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা যেতে পারে।
৫. হটলাইন ও অভিযোগ কেন্দ্র ব্যবহারে উৎসাহ
নারী ও শিশুদের ১০৯ নম্বর হটলাইনে ফোন দিয়ে অভিযোগ জানাতে উৎসাহিত করা উচিত। বিদ্যালয় ও কলেজে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা যেতে পারে।
৬. মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকা
টেলিভিশন, সিনেমা ও সামাজিক মাধ্যমে নারীদের প্রতি সম্মানজনক ও ইতিবাচক বার্তা তুলে ধরা জরুরি। অশ্লীল ও উত্ত্যক্ততামূলক কনটেন্ট বন্ধ করতে হবে।
৭. নারীদের আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ
নারীদের আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করতে পারবে।
ইভটিজিং প্রতিরোধের জন্য শুধুমাত্র আইন নয়, প্রয়োজন সমন্বিত সচেতনতা ও নৈতিকতার উন্নয়ন। সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করলেই আমরা গড়তে পারি এক নিরাপদ, সম্মানজনক ও সভ্য সমাজ।
ইভটিজিং রোধ করা প্রয়োজন কেন
ইভটিজিং বর্তমান সমাজে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যা নারী ও কিশোরীদের জীবনে অসহনীয় যন্ত্রণা ও ভয়ের সৃষ্টি করে। এটি শুধু একটি অপরাধই নয়, বরং সমাজের নৈতিকতা ও মানবিকতার অবক্ষয়ের এক নির্মম উদাহরণ। ইভটিজিংয়ের ফলে নারীরা শিক্ষা, কর্মস্থল ও সমাজে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার সমাজ গঠনের পথে ইভটিজিং একটি বড় প্রতিবন্ধক। তাই একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে ইভটিজিং রোধ করা আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সকলের সম্মিলিত উদ্যোগেই গড়ে তুলতে হবে ইভটিজিংমুক্ত একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা।