অটিজম কি | অটিজম কাকে বলে | অটিজম কত প্রকার
অটিজম একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল অবস্থা, যা মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলে। এটি সাধারণত শৈশবে চিহ্নিত হয় এবং ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ, ভাষা ব্যবহার ও আচরণে ভিন্নতা সৃষ্টি করে। অটিজমের কারণে অনেক সময় মানুষের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি ও পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়া আলাদা হতে পারে। এই আর্টিকেলে অটিজমের বৈশিষ্ট্য, কারণ, চিহ্ন ও সমর্থনের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
অটিজম কি
অটিজম হলো একটি জটিল নিউরোডেভেলপমেন্টাল অবস্থা যা মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ, ভাষা বোঝা ও ব্যবহারে সমস্যা হয় এবং তাদের আচরণে বিশেষ ধরণের পুনরাবৃত্তিমূলক কার্যকলাপ দেখা যায়। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD) নামেও পরিচিত, কারণ এর লক্ষণ ও গম্ভীরতা বিভিন্ন রকম হতে পারে। এটি জন্মগত বা শৈশবেই প্রথম ধরা পড়ে।
অটিজম কত প্রকার
অটিজম প্রধানত অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD) হিসেবে পরিচিত, যা বিভিন্ন ধরনের ও মাত্রার হতে পারে। এর প্রধান প্রকারগুলো হলো:
-
ক্লাসিক্যাল অটিজম (Autistic Disorder): সামাজিক যোগাযোগ ও আচরণে বিশাল সমস্যা দেখা যায়।
-
অ্যাসপারগার সিনড্রোম (Asperger Syndrome): ভাষাগত সমস্যা কম, তবে সামাজিক দক্ষতা সীমিত।
-
পের্ভাসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (PDD-NOS): মাঝারি ধরনের অটিজম, সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য না থাকা।
-
চিন্ডার ডিজঅর্ডার (Childhood Disintegrative Disorder): শুরুতে স্বাভাবিক শিশুর পর হঠাৎ অটিজমের লক্ষণ দেখা দেয়।
এসব প্রকারের লক্ষণ ও গম্ভীরতা ভিন্ন হতে পারে।
অটিজম কি কারনে হয়
অটিজমের সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে গবেষণায় জানা গেছে এটি মস্তিষ্কের জেনেটিক এবং পরিবেশগত প্রভাবের সম্মিলিত ফল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো:
-
জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারের কারো অটিজম থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
মস্তিষ্কের বিকাশগত পার্থক্য: মস্তিষ্কের কিছু অংশের কাঠামো ও কাজের মধ্যে ভিন্নতা।
-
পরিবেশগত কারণ: গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা, ইনফেকশন, ওষুধ বা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শ।
-
অন্যান্য কারণ: প্রিম্যাচিউর জন্ম, কম ওজন, বা বিশেষ ধরনের জেনেটিক অস্বাভাবিকতা।
এই কারণগুলো একসাথে বা আলাদাভাবে অটিজম সৃষ্টি করতে পারে।
অটিজম কি ধরনের সমস্যা
অটিজম একটি জটিল স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা, যা মূলত শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, ভাষা ও আচরণে প্রভাব ফেলে। এটি "অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD)" নামে পরিচিত, কারণ এটি বিভিন্ন মাত্রার ও ধরনভেদে ব্যক্তিভেদে ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। অটিজমের সমস্যাগুলো সাধারণত জীবনের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। এটি আজীবন স্থায়ী হতে পারে, তবে সঠিক চিকিৎসা, শিক্ষা ও যত্নের মাধ্যমে অনেক উন্নতি সম্ভব।
অটিজম প্রধানত তিনটি বড় ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করে
১. সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা:
অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সাধারণভাবে অন্যদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অসুবিধা বোধ করে। তারা কারও সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে বা মানসিক সংযোগ স্থাপন করতে পারে না। মুখভঙ্গি, হাসি, ইশারা বা শারীরিক ভাষা বুঝতে কষ্ট হয়। অনেক সময় তারা অন্যের অনুভূতি বা আবেগ বোঝে না বা তার প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না।২. ভাষা ও কথোপকথনের সমস্যা:
অনেক অটিস্টিক শিশু দেরিতে কথা বলা শুরু করে, আবার কেউ কেউ কথাই বলতে শেখে না। যারা কথা বলতে পারে, তারাও প্রায়ই অস্বাভাবিক উচ্চারণ, এককথার পুনরাবৃত্তি (echolalia), বা প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলে। তারা সাধারণভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না বা মনের ভাব ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না।৩. আচরণগত সমস্যা
অটিজম আক্রান্ত শিশুরা প্রায়ই একই কাজ বারবার করে (যেমন—হাত নাড়া, বসে-বসে দোল খাওয়া), একটি নির্দিষ্ট খেলনা বা রুটিনে অত্যধিক আসক্ত থাকে। নতুন পরিবেশ বা পরিবর্তন এলে তারা অস্বস্তি বোধ করে এবং রেগে যেতে পারে। তারা অস্বাভাবিকভাবে কিছু জিনিসে অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখাতে পারে এবং অন্য জিনিসে একেবারে আগ্রহ না-ও থাকতে পারে।
এই সমস্যা তিনটি ছাড়াও অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা, খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা (শব্দ, আলো বা ছোঁয়া সহ্য করতে না পারা) ইত্যাদি উপসর্গও দেখা যেতে পারে।
অটিজমের লক্ষণ ও সমস্যা ব্যক্তি অনুযায়ী ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়, তাই একে একটি “স্পেকট্রাম” হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ হালকা মাত্রার অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে, আবার কেউ গুরুতর মাত্রায়ও ভুগতে পারে। তবে দ্রুত শনাক্তকরণ, সঠিক চিকিৎসা, থেরাপি ও পরিবারের সহযোগিতার মাধ্যমে অনেক অটিজম আক্রান্ত শিশু স্বাভাবিক জীবনে উন্নতি করতে সক্ষম হয়।
অটিজম এর নতুন চিকিৎসা
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD) একটি জটিল স্নায়ুবিক বিকাশজনিত অবস্থা, যার জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে অটিজম ব্যবস্থাপনায় নতুন কিছু পদ্ধতি ও থেরাপি উদ্ভাবিত হয়েছে, যা উপসর্গ হ্রাস ও জীবনমান উন্নতিতে সহায়ক হতে পারে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য নতুন চিকিৎসা ও হস্তক্ষেপের বিবরণ দেওয়া হলো
🧪 ১. ক্যানাবিডিওল (CBD) থেরাপি
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানাবিস উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ক্যানাবিডিওল (CBD) অটিজম আক্রান্ত শিশুদের আচরণ উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৫ থেকে ২১ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে CBD ব্যবহারে সামাজিক প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি, বিরক্তিকর আচরণ হ্রাস, উদ্বেগ কমানো এবং ঘুমের মান উন্নত হয়েছে। তবে গবেষকরা আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন ।
💊 ২. লিউকোভোরিন (Leucovorin) থেরাপি
লিউকোভোরিন, যা মূলত কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়, কিছু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে ফলেটের ঘাটতি থাকা শিশুদের মধ্যে এই ওষুধ ব্যবহার করে ভাষাগত উন্নতি সাধিত হয়েছে ।
🧠 ৩. গাট-মস্তিষ্ক সংযোগ ও মাইক্রোবায়োম থেরাপি
গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অন্ত্রে কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিকের ঘাটতি রয়েছে, যা মস্তিষ্কের আবেগ ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গবেষণা গাট-মস্তিষ্ক সংযোগের গুরুত্ব তুলে ধরে এবং ভবিষ্যতে গাট মাইক্রোবায়োমকে লক্ষ্য করে নতুন থেরাপির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে ।
🧬 ৪. এপিজেনেটিক থেরাপি
এপিজেনেটিক থেরাপি, যা জিনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে, অটিজম ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। এই থেরাপিতে হিস্টোন ডিএসিটাইলেস ইনহিবিটরস (HDACi) এবং ডিএনএ মিথাইলট্রান্সফারেজ ইনহিবিটরস (DNMTi) ব্যবহার করে জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যদিও এই থেরাপি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, ভবিষ্যতে এটি অটিজম চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ।
🧩 ৫. নিউরোফিডব্যাক ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) গেম থেরাপি
"Eggly" নামক একটি মোবাইল গেম, যা EEG হেডব্যান্ড ও ট্যাবলেট ব্যবহার করে, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মনোযোগ ও সামাজিক দক্ষতা উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। এই গেমটি শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিগতকৃত প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতা প্রদান করে ।
🤖 ৬. রোবট-সহায়িত থেরাপি
সামাজিক রোবট ব্যবহার করে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের "joint attention" বা যৌথ মনোযোগ উন্নত করার জন্য নতুন অ্যালগরিদম তৈরি হয়েছে। এই রোবট-সহায়িত থেরাপি শিশুদের সামাজিক ও জ্ঞানীয় বিকাশে সহায়তা করতে পারে ।
🎨 ৭. শিল্প ও সংগীত থেরাপি
শিল্প থেরাপি, যেমন চিত্রাঙ্কন ও বুনন, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের আত্ম-প্রকাশ ও সামাজিক দক্ষতা উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মিশরে শিল্প থেরাপি ব্যবহার করে শিশুদের আত্মসম্মান ও দৈনন্দিন জীবনের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে ।
🐴 ৮. ঘোড়া-সহায়িত থেরাপি (Equine-Assisted Therapy)
ঘোড়া-সহায়িত থেরাপি অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মোটর দক্ষতা, ভারসাম্য, আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক যোগাযোগ উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। এই থেরাপিতে শিশুদের ঘোড়ার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে মানসিক ও শারীরিক উন্নতি সাধিত হয় ।
🏊 ৯. বিশেষায়িত সাঁতার প্রশিক্ষণ
ফ্লোরিডায় "Small Fish Big Fish" সাঁতার স্কুল অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যা তাদের পানিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। এই প্রশিক্ষণ শিশুদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও আনন্দ প্রদান করে ।
🚨 ১০. জরুরি সেবা কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালিংফোর্ড শহরে জরুরি সেবা কর্মীদের অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া উন্নত করতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এই উদ্যোগে বিশেষ তথ্য সংগ্রহ ও যোগাযোগের সরঞ্জাম ব্যবহার করে জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক সেবা নিশ্চিত করা হয় ।
🔬 ১১. নতুন ওষুধ: LIT-001 ও Alogabat
-
LIT-001: একটি অক্সিটোসিন রিসেপ্টর অ্যাগোনিস্ট, যা প্রাণীর মডেলে সামাজিক ঘাটতি হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ভবিষ্যতে মানব অটিজম চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে ।
-
Alogabat (RG-7816): একটি GABA_A রিসেপ্টর মডুলেটর, যা বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে এবং অটিজম ব্যবস্থাপনায় সম্ভাবনাময় ওষুধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ।
অটিজমের চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি ও থেরাপি উদ্ভাবিত হচ্ছে, যা আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নতিতে সহায়ক হতে পারে। তবে প্রতিটি থেরাপি বা ওষুধ ব্যবহারের আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে আরও গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে অটিজম ব্যবস্থাপনায় আরও কার্যকরী সমাধান পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।