ব্যাটারি চালিত রিকশা নিষিদ্ধ | সমাধান নাকি সংকট?
বাংলাদেশের শহর ও উপশহরগুলোর রাস্তায় যে যানটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তা হলো ব্যাটারি চালিত রিকশা। এটি এখন আর শুধু একটি বাহন নয় বরং একটি বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা ও জীবিকার উৎসে পরিণত হয়েছে। পরিবেশবান্ধব এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী এই রিকশাগুলো মানুষকে স্বল্প দূরত্বে স্বল্প খরচে চলাচলের সুবিধা দিয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে কিছু সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় ব্যাটারি চালিত রিকশা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ, এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এটি কি উন্নয়নের পদক্ষেপ, নাকি সাধারণ মানুষের জীবনে নতুন সংকট ডেকে আনার রাস্তায় হাঁটা?
ব্যাটারি চালিত রিকশা সমস্যা না সমাধান?
এই যানগুলো যেভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে—মানুষের প্রয়োজনীয়তার জায়গা থেকেই এর চাহিদা তৈরি হয়েছে। তবে এদের অধিকাংশই অবৈধ, নিবন্ধনবিহীন এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলে না। ফলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটি নিষিদ্ধ করার পক্ষে কিছু যুক্তি রয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন।
নিষিদ্ধের সম্ভাব্য সুফল | কী কী লাভ হতে পারে?
১. ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
এই যানগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচলের ফলে মূল সড়কে যানজট তৈরি হয়। এগুলো সরানো গেলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
২. দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাস
প্রশিক্ষণহীন চালকের কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নিষিদ্ধ হলে এই ঝুঁকি কিছুটা কমবে।
৩. বিদ্যুৎ অপচয় রোধ
বেশিরভাগ রিকশা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চার্জ করা হয়, যা জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
৪. পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা
যদি এই বাহনটি নিয়মের বাইরে চলতে থাকে, তাহলে পরিবহন খাতের বাকি অংশে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হবে। নিষিদ্ধ করলে সেটি রোধ করা সম্ভব।
নিষিদ্ধের ক্ষতিকর দিক | কী কী হারাবে সমাজ?
১. লাখো মানুষের বেকারত্ব
একটি ব্যাটারি রিকশা মানে একটি পরিবার। নিষিদ্ধ হলে সরাসরি হাজার হাজার পরিবার আয় হারাবে। এতে দারিদ্র্য বাড়বে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
২. স্বল্প আয়ের মানুষের যাতায়াত সংকট
ব্যাটারি রিকশা অনেকের জন্য একমাত্র সহজলভ্য বাহন। বাস, সিএনজি বা অন্য যান তাদের এলাকায় না থাকলে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়বে।
৩. ক্ষুদ্র ব্যবসা ধসের মুখে
এই রিকশা-নির্ভর ব্যবসা যেমন ব্যাটারি সরবরাহ, গ্যারেজ, মেরামত, যন্ত্রাংশ বিক্রেতা—সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৪. নারীদের চলাচলে সমস্যা
অনেক নারী ও স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী এই রিকশাগুলোতে নিরাপদভাবে যাতায়াত করেন। নিষিদ্ধ হলে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা সহজ নাও হতে পারে।
বাস্তবতা কি বলে | লাভ না ক্ষতি?
পরিবহন শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে নিষিদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি থাকলেও, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা ও ন্যূনতম চলাচলের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে যাবে। ফলে সামগ্রিক বিচারে বলা যায়, এই সিদ্ধান্তের ক্ষতির পরিমাণ লাভের চেয়ে বেশি।
সমাধান কী হতে পারে? সুপারিশসমূহ
নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে সরকার চাইলে এই খাতটিকে নিয়ন্ত্রণ ও আধুনিকায়নের আওতায় এনে একটি টেকসই সমাধান দিতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রস্তাব
১. নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক
প্রতিটি রিকশা ও চালককে রেজিস্ট্রারভুক্ত করে একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোতে আনা।
২. নির্দিষ্ট এলাকা ও সময় বেঁধে দেওয়া
মূল সড়ক বা অফিস টাইমে চলাচল সীমিত করে বিকল্প সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৩. সোলার বা উন্নত ব্যাটারির ব্যবহার উৎসাহ
পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের ভর্তুকি বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা।
৪. পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ
যাদের রিকশা চলানো সম্ভব নয়, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্যান্য পেশায় পুনঃস্থাপন করা।
৫. নগর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন
বাস ও অটোভ্যান বাড়িয়ে নাগরিকদের জন্য বিকল্প সেবা নিশ্চিত করা।
প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ নয় নিষেধাজ্ঞা
ব্যাটারি চালিত রিকশা সমস্যার উৎস নয়—বরং একটি অর্গানিক, জনসৃষ্ট সমাধান। সেটিকে অবৈধ ঘোষণা না করে, নিয়ম ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ বাহনে পরিণত করাই হবে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত, এক তরফা নিষেধাজ্ঞার বদলে জনস্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে উন্নয়ন হয় মানবিক, বাস্তবধর্মী ও টেকসই।